
১৯৩৭ সালের এক সকালে নবাগতার কণ্ঠী গলায় ঝুলিয়ে এক তরুণী সাহসিকতার সঙ্গে পা রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল মিনার-গম্বুজ শোভিত ভবনে। নাম তার কল্যাণী কর সরকার। পৈত্রিক নিবাস নারায়ণগঞ্জে হলেও স্বপ্ন ছিল বড়, মন ছিল কৌতূহলে পূর্ণ। ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে অর্থনীতি ও সংস্কৃতকে অনুষঙ্গী বিষয় হিসেবে বেছে নেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের কমনরুম, করিডোর, অধ্যাপক ও পাঠদানের রীতিনীতির যে বর্ণনা তিনি স্মৃতিচারণে তুলে ধরেছেন, তা যেন এক ঐতিহাসিক দলিল। সেই সময় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কথাবার্তা নিষিদ্ধ ছিল, নির্বাচন বা বিশেষ প্রয়োজনে কথা বলার জন্যও অনুমতি নিতে হতো প্রক্টরের কাছে। সমাজের প্রেক্ষাপটে এই নিয়মগুলো একদিকে যেমন হাস্যকর মনে হয়, তেমনি আবার তৎকালীন সময়ের কঠিন রক্ষণশীলতারও জানান দেয়।
কল্যাণী করের স্মৃতিচারণে উঠে আসে ছাত্রীনিবাসে কাটানো আনন্দঘন মুহূর্ত, ‘দিদি’ সিনেমা দেখতে যাওয়ার দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতা এবং তার পরিণতিতে উপাচার্যের শাস্তিমূলক চিঠি পাওয়ার মতো ঘটনা। সেই সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছিলেন, এমন নজির এই গল্পে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ছাত্রীসংঘের সৃষ্টি, সাহিত্য পত্রিকা ‘সুপর্ণা’ প্রকাশ, নামি কবিদের সঙ্গে কাজের সুযোগ—সব মিলিয়ে একটি মেয়ের শিক্ষাজীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল গৌরবময় ও অনুপ্রেরণাদায়ক। হ্যামলেট পড়ানোর সময় প্রফুল্ল কুমার গুহ বা ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’-এর পাঠদানকালীন প্রবোধকুমার লাহিড়ীর প্রাণবন্ত আলোচনা তখনকার শিক্ষাব্যবস্থার গভীরতা ও আদর্শিক জ্ঞানের প্রতিফলন।
স্মৃতিচারণের শেষভাগে কল্যাণী কর সরকার বলেন, আজও রমনার শান্ত পথে তার যৌবনের স্মৃতি ঘুরে বেড়ায়, সবুজ ঘাস, করিডোর, লাইব্রেরি যেন পুরনো দিনের গান গেয়ে তাকে ডাকছে ফিরে আসার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে আত্মীয়তাবোধ, তা জন্মেছে একত্রে গড়ে ওঠা সেই শিক্ষাজীবনের স্মৃতিগুলো থেকেই। তাঁর লেখা শুধু অতীতের দলিল নয়, বরং বর্তমান প্রজন্মের জন্য এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা—যেখানে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর সংগ্রামের অপূর্ব মেলবন্ধন রচিত হয়েছিল একটি মেয়ে শিক্ষার্থীর সাহসী পদচারণায়।